অনলাইন ডেস্ক 226

গল্প : বিশ্বাস আর আস্থায় নতুন জীবন

আফরিন জাহান হাসি: মেয়ের ‘সেক্সুয়াল হেলথ এডুকেশন’-এর ফরম কি পূরণ করব, কী ডিসিশন নিলা? তুমি বলেছিলে কারিকুলামটা ভালোভাবে দেখবা, দেখেছ?

আহির বলে উঠল, ও ক্লাস করবে, ডিসিশন তো প্রথম থেকেই এটা, কারিকুলাম তো দেখছি নিজে শেখার জন্য, কোন ক্লাসে কতটা শেখাচ্ছে, কীভাবে শেখাবে! দেখো, কানাডায় স্কুলের কারিকুলামে কোনো ব্যক্তি এটা চট করে ঢুকিয়ে দেয়নি, যথেষ্ট চিন্তাভাবনা, শ্রম ও আলোচনার পরেই এটা হয়েছে। আর কারও কোনো অবজেকশন থাকলে সেটাও জানানোর সুযোগ আছে। তা ছাড়া যার ইচ্ছা হবে না, তার বাচ্চা ওই ক্লাস করবে না, সে জন্যই তো এই ফরম। কিন্তু আমরা তো চাই মেয়ে শিখুক। ওকেও জিজ্ঞেস করো, ওদের শিক্ষক কোনো ধারণা দিয়েছেন কি না, ও চায় কি না এই ক্লাস নিতে।

তুমিই না বলো বাচ্চারা যেন সবকিছু নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারে, সেই পরিবেশটাই তাদের দিতে চাও। জানতে–শিখতে কোনো প্রশ্ন করতে যেন ভয় না পায়। বেশি নিষেধের বেড়াজাল থাকলে তো সেটা হবে না। ওদের সঙ্গে বিশ্বাস আর আস্থার সম্পর্ক তৈরিটাই সবচেয়ে জরুরি।

হ্যাঁ, আমি তো সেটাই বিশ্বাস করি। তবু মাঝেমধ্যে কারও কারও কথায় অস্বস্তিতে পড়ে যাই, আমার চিন্তায় কোনো ভুল নেই তো! তাই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইলাম। আজকে এক ভাবি বললেন, তাঁর বাচ্চাকে অনুমতি দেবেন না, আরও কয়েকজনেরও নাকি একই মত। এসব ক্লাস করে বাচ্চারা নাকি বেশি অ্যাডভান্স হয়ে যাবে, ট্রাই করে দেখতে চাইবে! আমি বলেছিলাম, নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে বেশি, বরং বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে গিয়ে উল্টোপাল্টা শিখবে, তার চেয়ে সরাসরি শিক্ষকদের কাছ থেকেই শেখা ভালো।আমার সঙ্গে তিনি একমত নন। আমি ওনাকে আমার ছোটবেলার একটা উদাহরণ দিয়েছিলাম। আমি দেখেছি, আমার সহপাঠী যাদের বাসায় খুব বেশি বিধিনিষেধ ছিল, তারা লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কিছু করত! কিন্তু আমি নিজে যেহেতু কথাবার্তা বলার পরিবেশ পেয়েছিলাম, তাই সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আবদারও করতে পেরেছিলাম এবং বড়দের সঙ্গেই গিয়েছিলাম। অথচ আমার কয়েকজন সহপাঠী স্কুল পালিয়ে গিয়েছিল, বাসা থেকে অনুমতি পাবে না তাই।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বারবারই মনে হয় এ পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থাটা জরুরি। তুমি তো দেখেছ আমাদের বাড়িতে কত মানুষের যাতায়াত ছিল, কারও সঙ্গে মেলামেশাতেও তেমন কোনো নিষেধ ছিল না। কথাবার্তা হতো সবার সামনেই, একসঙ্গে। কিন্তু স্পষ্ট করে বলে দেওয়া ছিল, পড়াশোনাটা কত জরুরি, যোগ্য জীবনসঙ্গী কীভাবে জীবন সুন্দর করে। দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট কথার মধ্যেই কত সাধারণভাবে বিষয়গুলো শিখিয়ে দেওয়া হতো! কখনো কখনো আম্মা অবশ্য সতর্ক করত, কারও সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশা দেখলে। সেই সঙ্গে আবারও মনে করিয়ে দিতেন জীবনের নীতি–নৈতিকতাগুলো।  

দুষ্টু হাসি দিয়ে আহির বলে ওঠে, ওরে বাবা, দেখিনি আবার! এত এত ছেলের আনাগোনা দেখে ভয়ে, ঈর্ষায় বুকে জ্বালাপোড়া হতো। মনে হতো, কখন কে তোমাকে জয় করে নিয়ে যাবে! ওসব তুমি বুঝবে না, তোমাকে তো আর ওই পরিস্থিতেতে পড়তে হয়নি। কিন্তু তুমি তো মনে হচ্ছে এখন খুবই চিন্তিত?

আসলেই চিন্তিত, ভাবছি, কোনটা সঠিক! ভাবি এ–ও বলল, ‘এত যে আলোচনার কথা বলছেন, আপনি কি জানিয়ে প্রেম করেছিলেন, তাদের বিশ্বাস রেখেছিলেন?’ আমাদের সমাজে ওই সময় প্রেম বিষয়টাকে ভালোভাবে দেখা হতো না, তারপরও আমাকে শেখানো হয়েছিল, ঠিকঠাক পড়াশোনা শেষ করে, এরপর সঠিক সময়ে, কাউকে পছন্দ হলে যেন নির্ভয়ে জানাই। সেই আশ্বাসের কারণেই, যেন বিশ্বাস ভঙ্গ না হয়, তাই আমি ছোট ভাইয়াকে জানিয়েছিলাম তোমার বিষয়টা। ভাইয়া বলেছিল, তখনই কথা না দিতে, তোমার কাছে সময় চাইতে, পড়াশোনাটা শেষ করতে। এ কথাগুলো শুনে ভাবি জয়ের হাসি হেসে বললেন, ‘সেটাই হয়, ছেলেমেয়েদের শাসনে না রাখলে কেউই কথা শোনে না!’

কিন্তু তারপরও আমার মনে হয় খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ থাকলে মানুষ ভুল করে কম। সারাক্ষণ শাসন আর ভয়ের পরিবেশে মানুষ স্বাভাবিকতা হারায়, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে না। শুধু বাচ্চাদের সঙ্গেই নয়, পরিবারের প্রতিটি মানুষের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কটা এমন হওয়া চাই। সবার প্রথমে অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকতে হবে এ গুণ। ইদানীং পরকীয়া সম্পর্কের কথা শুনছি, যদি নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক থাকে, বিশ্বাস থাকে, থাকে বন্ধুত্ব আস্থা, তখন কি পরকীয়া সম্ভব! ফেসবুকের কল্যাণে হাজারো বন্ধু থাকুক না, কিন্তু বন্ধুর সীমারেখায় থাকবে বন্ধু।

ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করার ট্রেনিং নিতে গিয়ে দেখেছি, কোন ধর্মের ভয় বা শিক্ষক, মা–বাবার ভয় দেখিয়ে নয়, নিজের বিবেকের কাছে খাঁটি হতে সত্যবাদিতা, স্পষ্টবাদিতা শেখানো হচ্ছে বাচ্চাদের। নিজের বিবেকের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে শিখলে তো আর কোনো অনৈতিকতার ভয় থাকে না। আমার মা যেমন বলত, ‘নিজে ভালো হলে জগৎই ভালো।’

আহির জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার এই সুন্দর চিন্তায় সংশয় এনো না, পারলে সবাইকে শেখাও, জানাও—বিশ্বাসের সঙ্গে, আস্থার সঙ্গে মন খুলে কথাবার্তার পরিবেশ কত প্রয়োজনীয়। বাচ্চাদেরকে জানাও, ‘আমরা তোমাদের বিশ্বাস করি, তোমরা আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারো।’ সত্যি, কানাডায় এসেই এটা আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে শিখেছি। জানার-শেখার মনমানসিকতা সব সময় ছিল বলেই হয়তো শেখাটা সহজ হয়েছে। যেন নতুন করে জীবনকে পাওয়া। বিশ্বাস আর আস্থা মিলে ভালোবাসার জীবন, স্বস্তির জীবন।  

লেখক: আফরিন জাহান হাসি, ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা

এই বিভাগের আরও খবর

মহান স্বাধীনতা দিবস
মহান স্বাধীনতা দিবস

মহান স্বাধীনতা দিবস

আমি মুজিব কন‍্যা বলছি
আমি মুজিব কন‍্যা বলছি

আমি মুজিব কন‍্যা বলছি

গল্প : বিশ্বাস আর আস্থায় নতুন জীবন
গল্প : বিশ্বাস আর আস্থায় নতুন জীবন

গল্প : বিশ্বাস আর আস্থায় নতুন জীবন

টিনএজের খেয়াল
টিনএজের খেয়াল

টিনএজের খেয়াল

‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’-এর মোড়ক উন্মোচনে শাজাহান খান
‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’-এর মোড়ক উন্মোচনে শাজাহান খান

‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’-এর মোড়ক উন্মোচনে শাজাহান খান

গল্প : ধূসর
গল্প : ধূসর

গল্প : ধূসর

মমতাজউদদীন নাট্যকার পুরস্কার পাচ্ছেন রুমা মোদক
মমতাজউদদীন নাট্যকার পুরস্কার পাচ্ছেন রুমা মোদক

মমতাজউদদীন নাট্যকার পুরস্কার পাচ্ছেন রুমা মোদক

close